#Article370: জেলার প্রাক্তন সৈনিকদের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি ভারত সরকার জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ-এর উপর থেকে সংবিধানের বিতর্কিত ৩৭০ ধারা ও ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে। এর ফলশ্রুতি জম্মু ও কাশ্মীর একটি কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে লাদাখকে অপর একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, এই ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের সার্বভৌম ও স্বাধীনতার পরিপন্থী, যা কাশ্মীরে শান্তি প্রক্রিয়ার বদলে উপত্যকায় জন্ম দিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদের৷এর মোকাবিলায় ভারতের বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনী সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে৷এই লড়াইয়ে শামিল বিভিন্ন নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত মালদা জেলার বিভিন্ন প্রান্তের ব্যক্তিগণ৷ তাঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এই আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছেন৷আজ ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে সেই সকল বীরদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা তাঁদের কার্যকালে কাশ্মীরের অবস্থান ও তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
নীলমণি পান্ডে, ফ্লাইং অফিসার
১৯৬২ সালে আমি বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় প্রথম চিনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হই৷পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করি৷এরপর আবার ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে শামিল হই৷এই যুদ্ধের সময় পাকিস্তান পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে৷ এর ফলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি হয়৷সেই সময় আমি পাঠানকোটে কর্মরত ছিলাম ও আমার সহযোগী ছিলেন পরমবীর চক্র বিজেতা (মরণোত্তর) ফ্লাইং অফিসার নির্মলজিৎ সিং শেখোন, যাঁকে জেনেভা চুক্তি লঙ্ঘন করে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেছিল৷এরপরে যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৭২ সালে আমি অবন্তিপুরা এয়ারবেসে যোগদান করি ভারতীয় বিমানবাহিনীর ২৩ নম্বর স্কোয়াড্রনে৷মূলত অবন্তিপুরা ছিল কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যেখানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অনেক আগে থেকেই চলত৷কিন্তু সেই সময় এই সন্ত্রাসবাদীদের হাতিয়ার ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এর অধিকাংশই তাদেরকে সরবরাহ করত পাকিস্তান৷সন্ত্রাসবাদীদের একটাই লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রাণহানি ঘটানো ও বিভিন্ন সরকারি সম্পত্তি এমনকি, সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানো৷তবে সেই সময় তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা অতটা উন্নত ছিল না৷বর্তমানে সন্ত্রাসীদের মধ্যে যে যোগাযোগ এবং আধুনিকীকরণ দেখা যাচ্ছে তা ততটা ছিল না৷তবে সেই সময়ে সন্ত্রাসবাদীরা সাধারণ কাশ্মীরিদের থেকে বেশিরভাগ বাইরের লোকদের উপর এই টার্গেট করত- অনেকটা আবেগের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সাম্মানিক ফ্লাইং অফিসার নীলমণি পান্ডে৷
সুরেশচন্দ্র দাস, হাবিলদার
‘১৯৭১ সালে নর্দার্ন কমান্ডের অধীন সিগন্যাল রেজিমেন্টের সদস্য হিসাবে আমি জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখের লেহ-তে তিন বছর কর্মরত ছিলাম৷সেই সময়ই মূলত সন্ত্রাসবাদী গতিবিধি ছিল কাশ্মীর অঞ্চলে৷জম্মু এবং লাদাখ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী গতিবিধি তেমন ছিল না’ এ কথা জানালেন অবসরপ্রাপ্ত সাম্মানিক হাবিলদার সুরেশচন্দ্র দাস৷
নীরেন্দ্রনাথ সরকার, নায়েক সুবেদার
‘১৯৮৯ সাল থেকে তিন বছরের জন্য আমি জম্মুতে কর্মরত ছিলাম৷আমাদের ইউনিট থেকে রাজৌরি বর্ডার ছিল ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে। যদিও জম্মুতে সন্ত্রাসবাদী হামলা সেরকম ছিল না, কিন্তু সীমান্তের এলাকাগুলি এত দুর্গম ছিল যে, দিনের বেলায় সেখানে সেনাবাহিনীর পক্ষে পাহারা দেওয়া যথেষ্ট কষ্টকর ছিল এবং এলাকাটি এত দুর্গম ছিল যে সেখান দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে অনুপ্রবেশকারীরা পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করতে পারত৷শুধুমাত্র কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীরা নয় পাঞ্জাবের আতঙ্কবাদী সংগঠন বববর খালসা-র সদস্যরাও এই এলাকা থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালাত’ এ কথা জানালেন সাম্মানিক নায়েক সুবেদার নীরেন্দ্রনাথ সরকার৷
বলরাম রায়, নায়েক সুবেদার
সাম্মানিক নায়েক সুবেদার বলরাম রায় বলেন, ‘১৬ কোর ডেল্টা ইউনিটের সদস্য হিসাবে আমি ১৯৯০ সাল থেকে জম্মুর রাজৌরি সেক্টরে কর্মরত ছিলাম আমি৷সন্ত্রাসবাদীরা সেনাবাহিনীর বা নিরাপত্তাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ত না, তাদের কাজ ছিল আচমকা কোনো বাজার বা বাসের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানো, যাতে এলাকার জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়৷আমার কার্যকালের সময়ে জম্মু বাস ডিপোতে একবার সন্ত্রাসবাদীরা বাসের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছিল৷তবে স্থানীয় মানুষজন সব সময় সেনাবাহিনীকে সহায়তা করত এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষজনের সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট ভালো’৷
যে সমস্ত বক্তব্যগুলি তুলে ধরা হল সেই সকল বক্তব্যগুলি ছিল মালদা জেলার প্রাক্তন সৈনিকদের, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে কাশ্মীরে কর্মরত ছিলেন৷ভারতীয় প্রাক্তন সৈনিক সংঘের মালদা জেলা শাখার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত মালদা জেলার বাসিন্দা সৈনিকদের প্রায় ৮০ শতাংশ কোনো সময়ে কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় তিন বছরের জন্য কর্মরত ছিলেন অথবা বর্তমানে কর্মরত অবস্থায় আছেন৷এর কারণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত হতে হলে তাদের কিছু সময়কালের জন্য নর্দার্ন কমান্ডের অধীনস্থ থাকতে হয়৷এই নর্দার্ন কমান্ডের অধীনস্থ এলাকা হল জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ অঞ্চল৷ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময়ে কর্মরত অবস্থায় বেশ কিছু সৈনিক কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় তাঁদের জীবন বলিদান দিয়েছেন৷এর মধ্যে হবিবপুর নিবাসী সিপাই বাদল হাঁসদা কাশ্মীরের নৌসেনা সেক্টরে আতঙ্কবাদীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজের জীবন বলিদান দিয়েছেন৷তাঁকে মরণোত্তর শৌর্যচক্র সম্মানে ভূষিত করা হয়৷আতঙ্কবাদীদের মোকাবিলায় সিপাই সঞ্জয় সরকার নিজের জীবন বলিদান দিয়েছেন৷তাঁকে মরণোত্তর সেবা মেডেল প্রদান করা হয়েছে৷এছাড়া নায়েক ললিতচন্দ্র মণ্ডল, লেফটেন্যান্ট নায়েক জগরানাথ মণ্ডল, লেফটেন্যান্ট নায়েক তাবরুক আনসারি কাশ্মীরের আতঙ্কবাদের মোকাবিলায় শহিদ হয়েছেন৷
জেলার প্রাক্তন সৈনিকদের বক্তব্য, সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরের জন্য যে বিশেষ মর্যাদা দান করা হয়েছিল তাতে কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তি তো আসেনি, উলটে ভূস্বর্গ কাশ্মীর উপত্যকা যথেষ্ট হিংসা কবলিত হয়েছে৷যার ফলস্বরূপ প্রায় ৫০ হাজারের ওপর নির্দোষের প্রাণহানি ঘটেছে৷ প্রাক্তন সৈনিকরা ৩৭০ ধারা বিলোপকে সমর্থন করেছেন এবং তাঁরা মনে করেন যে, এটি ছিল স্থানীয় শাসকদের স্বার্থের অনুকূল যার পরিণতি এই সন্ত্রাসবাদ৷ এই সন্ত্রাসবাদ দমনে ভারত সরকার সেনাবাহিনীকে কার্যত ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান না করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল বলে জেলার প্রাক্তন সৈনিকদের অনুযোগ৷তাই জেলার বর্তমান এবং প্রাক্তন সৈনিকগণ এই ধারা বিলোপের পক্ষে স্বাগত জানিয়েছেন৷তাঁদের অভিমত, এই ধারা বিলোপের ফলে ভারতবর্ষ বর্তমানে সত্যিকারের স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারল স্বাধীনতার ৭০ বছর পরে৷
Opmerkingen