গৌড়-পুণ্ড্রবর্ধন-অমরাবতীর স্পর্শ, মাটির পরতে পরতে লুকিয়ে ইতিহাস
বাংলার প্রবল পরাক্রমী হিন্দু রাজা শশাঙ্কের এই ভূমিতেই রয়েছে গৌড়-আদিনা, পুণ্ড্রবর্ধন-অমরাবতীর স্পর্শ৷ মালদার বুকেই গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধারক নন্দদির্ঘিক মহাবিহার৷ বিক্রমশীলার মতো জগজীবনপুরের এই মহাবিহারও ছিল বিদ্যাচর্চার আদর্শ কেন্দ্র৷ পাল বংশের একটা আস্ত অধ্যায় জগজীবনপুরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে৷ পাল বংশের মিসিং লিংক ধর্মপালের নাম জগজীবনপুরের বুক চিরেই বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু অবহেলার ধুলোয় ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন বাংলার সেই ঐতিহ্য৷ মাটি থেকে বেরিয়ে আসা ইতিহাস ফের ধরিত্রীর বুকেই মিলিয়ে যেতে পারে যে-কোনো সময়৷ নতুন করে খননকার্য শুরু তো দূরে থাক, আগাছা সরানোর উদ্যোগও চোখে পড়ে না৷ এনিয়ে প্রয়াত ইতিহাসবিদ কমল বসাকের যথেষ্ট আক্ষেপ ছিল৷ আক্ষেপের সুর শোনা গেল অধ্যাপক স্বপনকুমার মণ্ডলের গলাতেও৷ স্বপনবাবুর বক্তব্য, ইতিহাসকে ঘিরে গবেষণার বিপুল সম্ভাবনা সুপ্ত আছে এই জেলার অন্তরে৷আর ইতিহাসের ঐতিহ্য সংরক্ষণের সুযোগ পেলে পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে৷
১৫১৩ সালে তখন গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ৷ঠিক সে সময়েই রামকেলিতে এসেছিলেন ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা শ্রীচৈতন্যদেব৷ তিনি হোসেন শাহর দুই উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সাকর মল্লিক ও দবিরখাসের সঙ্গে মিলিত হন৷সম্পর্কে সাকর ও দবিরখাস দুই ভাই৷এই দু’জনকে ভক্তি আন্দোলনে যুক্ত করে সনাতন ও রূপ নামকরণ করেন চৈতন্য মহাপ্রভু৷ এমনকি পুরাতন মালদার মাধাইপুরের মন্দিরে শ্রদ্ধার জায়গা করে নিয়েছেন দুই ভাই৷
নীলাচল থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে রামকেলি এসেছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু৷রূপ-সনাতন অধ্যায় তখনকারই৷ রামকেলিতে চৈতন্যদেবের অবস্থান এই অঞ্চলকে গুপ্ত বৃন্দাবন নামে পরিচিতি দিয়েছে৷বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে এখানেই আবার মাতৃ পিণ্ডদানের আয়োজন হয়৷বিহার-ঝাড়খণ্ড সহ দূরদূরান্তের মানুষ পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে গৌড়ে আসেন৷ কিন্তু প্রচারের আলোয় সেভাবে না আসায় রামকেলি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি৷ রামকেলির মতোই ইতিহাসের বুক থেকে জেগে আছে গৌড় নগরীর সুলতানি স্থাপত্যগুলি৷ ফিরোজ মিনার, চিকা মসজিদ বা লোটন মসজিদের অপরূপ স্থাপত্য যে যুগের বৈভবকে ব্যক্ত করে৷ মহদিপুরে বাংলাদেশ সীমান্তে গৌড়ের প্রাচীন প্রাচীর আজও মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে৷ প্রাচীর সেই প্রাচীরের মাথাতেই বর্তমানে আবার বিএসএফের নজরদারি কুঠির অবস্থান৷ ওয়াঘা সীমান্তের মতো মহদিপুরেও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় সরকারের সদিচ্ছা থাকলে৷
১৫১৩ থেকে ১৭৯৪-এ পৌঁছে মালদার সঙ্গে জড়িয়ে যায় উইলিয়াম কেরির নামও৷ ইংল্যান্ডের নর্দাস্পটনশায়ারের কেরি ছিলেন একাধিক ভাষায় পারদর্শী৷ দিনেমার জাহাজে চড়ে কলকাতায় পৌঁছে যান তিনি৷ তারপর নীলকুঠির ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে আসেন মালদার মদনাবতীতে৷ এখানেই বাংলা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ শুরু করেন তিনি৷ সেই বাংলা বই ছাপার জন্য ১৭৯৮ সালে একটি মুদ্রণযন্ত্র কিনে মদনাবতীতে বসিয়েছিলেন কেরি সাহেব৷অর্থাৎ বাংলায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র এই মালদাতেই স্থাপিত হয়েছিল৷কিন্তু কেরির স্মৃতি বিজড়িত মদনাবতীই বিস্মৃতির অন্তরালে৷ভগ্নপ্রায় নীলকুঠি বাঁচার আপ্রাণ লড়াই চালাচ্ছে৷ বামনগোলার বিডিও শুভঙ্কর মজুমদারের উদ্যোগে অবশ্য নীলকুঠির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছে৷
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
コメント