বন্ধের বাঁধনে মালদা
দশের পর ছাব্বিশ৷ সাম্প্রতিক সময়ে পর পর দুটি বন্ধের সাক্ষী থাকলেন রাজ্যবাসী৷ প্রথমটি বাম-কংগ্রেসের, দ্বিতীয়টি বিজেপির৷ প্রতিটি দলই দাবি করেছে, এই বন্ধের সাধারণ মানুষের স্বার্থে ডাকা৷ বন্ধের পর মানুষের স্বার্থ কতটা উপকৃত হয়েছে তা অবশ্য জানা যায়নি৷ তবে বন্ধের প্রভাব অনুভব করেছেন সবাই৷
দাবি আদায়ে সেকাল থেকে ধর্মঘটের একাল
বন্ধের ইতিহাস অবশ্য অনেক পুরোনো৷ যতদূর জানা যায়, বন্ধের উৎপত্তি নীল নদের তীরে৷ ১১৫৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে মিশরের নির্মাণ কর্মীরা তাঁদের পারিশ্রমিকের জন্য টানা ১৮ দিন অপেক্ষা করেন৷তারপরেও পারিশ্রমিক না পেয়ে তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে পারিশ্রমিকের দাবিতে দার-এল মদিনাতে ধর্মঘটে শামিল হন৷ ভারতবর্ষে মানুষ বন্ধ দেখেছেন অবশ্য অনেক পরে৷অনেকের মতে, এদেশে সেই সংস্কৃতি আমদানি করেছে বামপন্থীরাই৷কবে থেকে ভারতবাসী বন্ধের মুখোমুখি হয়েছেন তা অবশ্য সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়৷ তবে ১৯২৮ সালে সিপিএমের পরিচালনায় টানা ৬ মাসের পাট শ্রমিকদের ধর্মঘট দেশের শিল্পে বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছিল৷
‘দিতে হবে, দিতে হবে৷ নিপাত যাক৷ চলছে না, চলবে না৷’ এসবই যে কোনও বন্ধের পরিচিত স্লোগান৷সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ কবে দেখা গিয়েছে তা কেউ বলতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ মূলত চাপিয়ে দেওয়া বন্ধ মানতে বাধ্য হন সবাই৷ সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে বন্ধের মানসিকতাও৷ তার ছবি সাম্প্রতিক সময়ে দেশ, রাজ্য, এমনকি আমাদের মালদাতেও ধরা পড়েছে৷ এই শহর শেষ বন্ধ দেখেছে গত ২৬ সেপ্টেম্বর৷ গেরুয়া শিবিরের ডাকা সেই বন্ধের উৎস ছিল উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর ব্লকের দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়৷ বাংলা ভাষার শিক্ষক চেয়ে সেখানে আন্দোলন হয়েছিল৷ সেই আন্দোলনে চলে গুলি৷ মারা যায় দুই প্রাক্তন ছাত্র৷ এরাজ্যে শাসকদলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলা বিজেপি এই ঘটনার সুযোগ নিতে দেরি করেনি৷
কিন্তু সেই বন্ধে কী দেখা গেল? প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন হরনাথ, পিন্টু, সেরাজুলরা৷ প্রত্যেকের বাড়িতেই ৫-৭টি পেট৷কাজ সেরে টাকা ঘরে না নিয়ে গেলে হয়তো সেদিন রাত থেকে পরের দিন পর্যন্ত উনুনে হাঁড়ি চড়বে না৷পরদিন ঘরের ছেলেমেয়েটা দু’মুঠো ভাত খেয়ে স্কুল যেতে পারবে না৷ কিন্তু বন্ধ সমর্থকরা রাস্তাতেই যাত্রী নামিয়ে রিকশার চাকার হাওয়া খুলে দিল৷ সেই রিকশাটি কীভাবে মালিকের কাছে চালকরা নিয়ে যাবেন, সেকথাও কেউ ভাবেনি৷ ভাবার কথাও নয়৷ কারণ, ওই হরনাথ, পিন্টু কিংবা সেরাজুল পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যই যে ডাকা হয়েছে বন্ধ৷ একই পরিস্থিতি সকাল সকাল শহরের রাস্তায় নামা সবজি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাকি দিন আনি দিন খাইদেরও৷ কিন্তু কিছু করার নেই৷ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা! জেলার বণিকসভা জানিয়ে দিল, বন্ধে কোনও দোকান খোলা হলে সমস্যা নেই৷ কিন্তু কোনও কারণে সেই দোকানের ক্ষতি হলে হাত গুটিয়ে নেবে বিমা কোম্পানিগুলি৷ তাই দোকান খোলার সাহস পেলেন না কেউ৷ উৎসব মরশুমে ব্যবসার ক্ষতি স্বীকার করলেন নীরবে৷
বিরোধীদের ডাকা বন্ধে সবসময়ই সতর্ক থাকে শাসক৷ বামেদের আমলে বিরোধীদের ডাকা বন্ধ ব্যর্থ করতে যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হত, এখন সেই ব্যবস্থা বেড়েছে কয়েকগুন৷ শুধু বন্ধের দিন নয়, তার আগের ও পরের দিনও সরকারি অফিসে সবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক৷ সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করা কি সম্ভব? তাই বন্ধ শেষে শাসকের গলায় শোনা গেল এই বন্ধ ব্যর্থ৷ পরিচালকদের গলায় বন্ধ সর্বাত্মক৷
কিন্তু দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা তাদের দাবিমতো শিক্ষক কি পেল? শাসক-বিরোধী তরজায় সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি৷
আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ছবিঃ মিসবাহুল হক
Comentarios