অনুঘটকের কাঁটা এখন মাথাব্যথা নীল-সাদার
লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে নীল-সাদার রেশ খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ এতদিন উত্তরে নিজেদের হাতে থাকা রাজবংশী ভোট ব্যাংকে কার্যত ধস নামিয়েছে গেরুয়া শিবির৷ অনুঘটক হয়ে বিজেপিকে সুবিধে করে দিয়েছে জেডিপি৷
গত ১৯ নভেম্বর মালদা কলেজ অডিয়োরিয়ামের দুর্গাকিংকর সদনে এই জেলার প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ বৈঠক করে গেলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান৷সেই সভা থেকে জেলার ৪২টি প্রকল্পের উদ্বোধনের পাশাপাশি ২২টি প্রকল্পের শিলান্যাসও করে গেলেন তিনি৷যদিও নিন্দুকদের একাংশ বলছে, মুখ্যমন্ত্রী যে প্রকল্পগুলির উদ্বোধন করলেন, তার বেশ কয়েকটির দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না৷তবে নিন্দুকরা নিন্দা করবেই, সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে উন্নয়নের রাস্তা ধরে৷জেলার উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে মালদাবাসী খোলামনেই স্বাগত জানিয়েছে৷যদিও এই জেলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনও কিছু দেয়নি৷তা নিয়ে সেদিনের প্রশাসনিক সভাতেও তিনি নিজের খেদ গোপন রাখেননি৷
কিন্তু সেদিনের প্রশাসনিক সভা ক্ষণিকের জন্য পরিবর্তিত হয়েছিল রাজনৈতিক সভায়৷যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন, কীভাবে ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি এই জেলায় একের পর এক পথ অবরোধ কর্মসূচি নিচ্ছে? কেন পুলিশ এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না? একধাপ এগিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো আরও বলেছিলেন, ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টিকে পিছন থেকে উসকানি দিচ্ছে হবিবপুরের দু’জন৷দিদি সেই দুই নেতার নাম না বললেও তাঁর নিশানায় যে উত্তর মালদার সাংসদ খগেন মুর্মু আর হবিবপুরের বিধায়ক জয়েল মুর্মু, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি জেলার রাজনীতির কারবারীদের৷মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরেই ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে জেলা পুলিশ প্রশাসন৷পুলিশের অন্দরমহলের আলোচনাতেও এখন প্রতিবেশী রাজ্যের এই রাজনৈতিক দল৷জানা যাচ্ছে, জেডিপির সাতকাহন খুঁজতে ময়দানে নেমে পড়েছে পুলিশ৷
মিম-জেডিপি অবরোধ তোলার পথ খুঁজছে শাসকদল
কিন্তু ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত অ্যালার্জি কেন? এর মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে গত লোকসভা নির্বাচনে৷অন্তত রাজনৈতিক মহল সেটাই মনে করছে৷মহলের বক্তব্য, সেই ভোটে উত্তরবঙ্গে নীল-সাদার রেশ খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথায়৷এতদিন উত্তরে নিজেদের হাতে থাকা রাজবংশী ভোট ব্যাংকে কার্যত ধস নামিয়েছে গেরুয়া শিবির৷অনুঘটক হয়ে বিজেপিকে সুবিধে করে দিয়েছে জেডিপি৷মালদা ও উত্তর দিনাজপুরের মুসলিম ভোট ব্যাংকও লোকসভা ভোটে শাসকদলকে বাঁচাতে পারেনি৷গোদের উপর বিষফেঁড়ার মতো এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে মাথা ঢোকাতে চলেছে সুদূর তেলেঙ্গানার আরেকটি রাজনৈতিক দল৷মূলত হায়দরাবাদেই তাদের অস্তিত্ব থাকলেও তারা এখন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে নিজেদের মাটি শক্ত করার চেষ্টা করছে৷সারা ভারত মজলিস-ই-ইত্তেহাদ-আল-মুসলিমিন এককথায় মিম পার্টি নামে পরিচিত৷দলের প্রধান, সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ইতিমধ্যে বিহারের কিছু অংশে দলের মাটি শক্ত করে ফেলেছেন৷যদিও এই দলটি কিন্তু অনেক পুরোনো৷পরাধীন ভারতে ১৯২৭ সালে এই দলের জন্ম৷ তৃণমূলের আশঙ্কা, এবার মিম এই বাংলাতেও যে কোনও সময় ঢুকে পড়বে৷আর তা হলে শাসকদলের মুসলিম ভোট ব্যাংকে যে ফের একবার আঘাত আসবে তা দলের বর্তমান মেন্টর, ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোরের অজানা নয়৷ আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে সম্ভবত পিকে’র দেখানো পথেই এবার জেডিপি ও মিমের বিরুদ্ধে অলআউটে খেলতে চলেছেন শাসকদলের নেতানেত্রীরা৷
রাজনৈতিক মহল বলছে, মিম নিয়ে এখনই তেমন ভাবার সময় আসেনি শাসকদলের৷এখন তাদের প্রধান মাথাব্যথা জেডিপিকে নিয়ে৷সেই কারণেই জেলার প্রশাসনিক সভায় ক্ষণিকের জন্য তৃণমূলনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷এনিয়ে প্রশ্নও তুলেছে রাজনৈতিক মহল৷মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে নিজের দলকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন৷প্রতিবেশী রাজ্যগুলির নির্বাচনে তাঁর দল প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে৷ভোটের সময় তৃণমূলের নেতানেত্রীরা সেই রাজ্যগুলিতে প্রচার চালিয়েছেন৷তৃণমূলের একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিও হয়েছে রাজ্যগুলিতে৷তাঁর নির্দেশে তৃণমূল যদি বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসমে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে পারে, তাহলে ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি এ’রাজ্যে তা করতে পারবে না কেন?
সম্ভবত সেকারণেই তৃণমূল সুপ্রিমোকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে জেডিপি নেতৃত্ব৷২০ নভেম্বর রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে জেডিপির মালদা জেলা সভাপতি রবীন মুর্মু বলেছেন, ‘মালদায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযান নিয়ে অনেক কথা বলেছেন৷আমরা তাঁর বক্তব্য খতিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছি, তিনি আদিবাসীবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ভাষা, ধর্মের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি৷মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই রাজ্যে বাংলার পর সাঁওতালি ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷কিন্তু এখনও পর্যন্ত এখানে সাঁওতালি ভাষায় পঠনপাঠনের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি৷এসব নিয়েই গত ১৮ নভেম্বর আমরা পথ অবরোধ কর্মসূচি নিয়েছিলাম৷শুধু এই রাজ্যেই নয়, দলিতদের স্বার্থ রক্ষায় দেশের পাঁচটি রাজ্যে আমাদের আন্দোলন চলছে৷মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাকে কী বললেন তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই৷ নিজেদের দাবি পূরণ না হলে আমরা পাঁচ রাজ্যে আরও বড়ো আন্দোলন সংগঠিত করব৷’
রবীনবাবুর বক্তব্যে পরিষ্কার, এই মুহূর্তে ধমকে, চমকে তাঁদের বিরত করা যাবে না৷তাই ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির কাঁটা তুলতে তৃণমূলের প্ল্যান-বি কী হয়, তা দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক মহল৷
ছবিঃ গৌতম কর্মকার।
Comments