top of page

রামকেলির গণউদ্ধার

গঙ্গাসাগর অথবা কুম্ভমেলা বাদ দিলে তামাম ভারতবর্ষ যে-কটি ঐতিহ্যমূলক মেলার জন্য বিখ্যাত, রামকেলি তার অন্যতম৷ বৈষ্ণবমতের অনুগামী মানুষের পাখির চোখ থাকে জ্যৈষ্ঠের শেষ তিনটি দিনের দিকে৷ শ্রী চৈতন্যদেবের পাদস্পর্শ রঞ্জিত রামকেলি পুণ্যধামের মাটির ছোঁয়ায় যেন তাঁদের মনুষ্য জন্মলাভের সার্থকতা৷ কিন্তু কেন? শ্রী চৈতন্যদেব তো আরও অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন৷ সব জায়গাতেই তো মেলার প্রচলন হয়নি৷ এমনও নয় যে, স্থানীয় দ্রব্য উৎপাদনের জন্য রামকেলি জায়গাটি বিখ্যাত, সেইসব দ্রব্য বিপণনের জন্য একটি মেলা নামক পরিসরের প্রয়োজন ছিল! আসলে সময়ের একটা বিরাট প্রয়োজন এবং প্রসাধনের শূন্যস্থান পূরণ করেছিল এই মেলা৷


Chaitanya Mahaprabhu
রামকেলির গণউদ্ধার

সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে রামকেলির গণউদ্ধার

রামকেলি মেলার সাথে বৈষ্ণব ধর্মের বিরাট আবেগ যেমন জড়িয়ে আছে তেমনি সমান্তরাল জনপ্রিয়তা ধারণ করে আছে ‘কণ্ঠিবদল’ নামের একটি প্রথা৷ মেলার অনেক ভিড়ে কৌতূহলী অনেক চোখ ঘুরে বেড়ায় সেই দৃশ্য দেখার জন্য, যেখানে নাকি ঘোমটার আড়ালে শত শত নারী কড়ে আঙুল বের করে অপেক্ষার সারি দিয়ে বসে থাকে পুরুষ সঙ্গী অনুসন্ধানের জন্য৷ এই সঙ্গী এক দিন, এক ঘণ্টার জন্য নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়েও নাকি নির্ধারিত হয়৷ যা কিনা আধুনিক নারী পণ্যলাভের আরও সহজ-সুলভ পথ৷ কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নিয়ে প্রথাটি শুরু হয়েছিল তার গভীরতায় এতটা চটুলতা ছিল না৷

স্মরণে রাখতে হবে আজ থেকে পাঁচশত বছর আগের গৌড়ের সামাজিক অবস্থাটা৷ দীর্ঘ একটা সময় ধরে শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার আর নারী মাংসলোভী মানুষের ব্যভিচারে গৌড়ভূমি নরকে পরিণত হয়েছিল৷ পাল আমলের পর বৌদ্ধ প্রভাব ক্ষীণ হয়ে এলে সেই সমাজের হীনযাত্রাচারী সহজপন্থী তান্ত্রিক কান্থাওয়ালা, কর্তা ভজা, কান ফুটো প্রভৃতি অন্ত্যজ সমাজের লোকেরা ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণের লোকদের দ্বারা ভীষণভাবে অত্যাচারিত হত৷ এইসব অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষকে নিয়ে বিশেষত মেয়েদের নিয়ে উচ্চশ্রেণির ইন্দ্রিয়লিপ্সু মানুষ কদাচারী হয়ে উঠেছিল৷ সেই সঙ্গে ছিল ব্রাহ্মণ সমাজ পরিত্যক্ত, স্বামীর স্নেহ বঞ্চিত, সমাজ বহিষ্কৃত নারী সমাজ৷ এরা চারিদিক থেকে সমাজবাদের অধিকার হারিয়ে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নানারকম অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিল৷ তাই এইসব নারীদের একদিকে যেমন সঙ্গী ছিল নিজের অপমান অন্যদিকে সেই কারণেই সমাজের মূলস্রোত থেকে তাদের অবস্থান অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছিল৷ এইসব অসংখ্য, অসহায়, ভাগ্য বিড়ম্বিত, অধিকার বঞ্চিত মানুষকে আবার সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই ছিল শ্রী চৈতন্যের অভিনব সমাজসংস্কার৷ শ্রী চৈতন্যের নির্দেশে তথা দেখানো পথ ধরে গৌর পার্ষদ নিত্যানন্দ অবধূত-এর উদ্যোগে রামকেলি গ্রামে প্রচলিত হয়েছিল পতিত উদ্ধার অনুষ্ঠান৷ পোশাকি নাম বৈষ্ণবকরণ, প্রচলিত নাম কণ্ঠিবদল৷

নিয়ম এইরকম যে, জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে রামকেলি গ্রামে রূপ-সনাতন শ্রীজীব প্রতিষ্ঠিত মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গণে ধর্মযজ্ঞ হত, বৈষ্ণব ধর্মগ্রহণে ইচ্ছুক নর-নারীকে পাঁচসিকে দক্ষিণার বিনিময়ে নাম লেখাতে হত৷পরদিন ভোররাতে অনুষ্ঠিত হত নব বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের জীবন সাধিকা বা সাধক গ্রহণ অনুষ্ঠান৷ তাঁরা রাধা-শ্যাম, ললিতা-বিশাখা ইত্যাদি নামের কুণ্ডের জলে স্নান করে, নতুন কাপড় পড়ে, গলায় তুলসীর মালায় পুরুষ ও নারী আলাদা পঙক্তিতে সেজে দাঁড়িয়ে থাকত৷ বৈষ্ণবীদের কেবল বাম হাতের ছোট্ট আঙুলটি বাইরে থাকত৷ প্রধান পুরোহিত একজন করে পুরুষ ডেকে নিয়ে জীবনসাথি গ্রহণ সংক্রান্ত কিছু শর্ত-বাণী পাঠ করাতেন৷ তারপর ওই ব্যক্তিকে বস্ত্রাবৃত নারীদের মধ্যে থেকে একজনকে আঙুল ধরে সাথি নির্বাচন করতে বলা হত৷ একেবারে শেষে নারী-পুরুষ উভয়কে দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত কিছু শপথবাক্য পাঠ করিয়ে সংসার জীবনযাপনের অনুমতি দেওয়া হত৷ ধর্মের অনুষঙ্গে এই প্রথা একদিকে সমাজ, সংসার-এর দেওয়া কলঙ্কিনী অথচ নিরপরাধ সবরকম নারী-পুরুষকে যেমন সমাজবাসের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিল তেমনি বৃদ্ধা, কুরূপা, পঙ্গু মেয়েরাও সংসার, পরিবার ফিরে পেয়েছিল৷ পতিত উদ্ধার বা গণবিবাহ নামে যাই বা হোক না কেন এই প্রথা খুব খারাপ একটা সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের মর্যাদা যে ফিরিয়ে দিয়েছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷

এই একবিংশ শতাব্দীতেও কন্যাবিবাহের বিপুল ব্যয়ভার এড়ানোর জন্য যখন পিতা-মাতা কন্যা ভ্রূণহত্যা করেন অথবা কন্যাসন্তানকে বোঝাস্বরূপ মনে করেন সেখানে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত এই প্রথা সমাজের অনেক অহিতকর অন্যায়ের পরিপন্থী ছিল বলাই বাহুল্য৷


আমাদের মালদা এখন টেলিগ্রামেও। জেলার প্রতিদিনের নিউজ পড়ুন আমাদের অফিসিয়াল চ্যানেলে। সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

Comments


বিজ্ঞাপন

Malda-Guinea-House.jpg

আরও পড়ুন

bottom of page