আচ্ছা, হঠাৎ একদিন গলার কাছে দলা পাকানো জট খুলে গেলে কেমন হয়? তাবড় তাবড় বিশারদদের কাছ থেকে সদুত্তর না পাওয়া প্রায় দেড় দশক ধরে জমে থাকা জট। ‘মালদা আগামী’ প্রযোজনা ‘থেরীগাথা আম্রপালী’ তারই দৃষ্টান্ত। পার্থ মুখোপাধ্যায়ের মূল নাটকটির সম্পাদনা ও নির্মাণ করেছেন জয়ন্ত ক বিশ্বাস। এদিন মালদা কলেজ অডিটোরিয়ামে এই নাটকটি দ্বিতীয়বার প্রদর্শিত হল।
সময়টা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের। প্রেক্ষাপট এই ভারতবর্ষের বুকেই দাঁড়িয়ে থাকা এক গণতান্ত্রিক জনপদ বৃজ্জি ও তারই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী মগধ। কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃজ্জির রাজধানী বৈশালীর এক উদ্যানপালক মহানামের পালিতা কন্যা আম্রপালী।
গণতান্ত্রিক বৈশালীতে 'আমরা সবাই রাজা'র রাজত্ব। জনগণের কাছে বৈশালী শুধু রাজ্য নয়, 'বৈশালী মাতা'। অথচ গণতন্ত্রের তোপ দিয়ে রাজ্য চালাচ্ছেন রাজ্যের পুঁজিবাদী শ্রেষ্ঠী ও বণিক সম্প্রদায়। সেই রাজ্যেরই চতুর্দশবর্শীয়া সুন্দরী বালিকা আম্রপালীর ওপর নজর পরে বণিকদের একাংশের। তাকে হস্তগত করার বাসনায় বসে সভা। সভায় ঠিক হয়, বৈশালীর আভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষার্থে প্রায়-অভিভাবকহীন রূপসী আম্রপালীকে হতে হবে বহুভোগ্যা নগরবধূ। 'বৈশালী মাতা'র রক্ষার্থে আম্রপালীকে উৎসর্গ করতে হয় নিজ শরীর, নিজ কৈশোর, যৌবন।
গণতন্ত্র নামক রঙিন ফলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কদর্য সামন্ততন্ত্র তখন প্রকাশ্যে আসে। মাতা বৈশালীকে সামনে রেখে বৈশালীর কন্যাকেই বলি দিতে হয় তার সর্বস্ব। গণতন্ত্র তখন পরিহাস মাত্র।
প্রথম বিরতির পর শুরু হয় যুবতি আম্রপালীর যাত্রা। মগধ থেকে যুদ্ধ বাসনায় বিম্বিসারের আগমন, বর্ষা রজনীতে আম্রপালীর সাথে বিম্বিসারের মিলনদৃশ্য মঞ্চ জুড়ে মোহপর্দা বিস্তার করে। কাহিনীর পরতে পরতে এখানে যৌবনের রং। যদিও আম্রপালী ও বিম্বিসারে এক-রজনীর মিলন দৃশ্যটি কিছু কিছু স্থানে হঠাৎ দুর্বল মনে হয়েছে।
মোক্ষ বা শেষ পর্বে রাজনীতি ও ধর্মের উদ্যত খড়গ প্রকটভাবে উঠে আসে মঞ্চে। বুদ্ধপন্থী রাজা ও বেদপন্থী মহামাত্য বর্ষকার সুপ্ত দ্বন্দ্ব একসময় রাজনৈতিক পালাবদলের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিম্বিসার পুত্র অজাতশত্রুকে ঢাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে মহামাত্য বর্ষকা, অজাতশত্রু জননী চেল্লানা ও শ্রমণ দেবদত্ত নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির খেলায় মত্ত হয়। অন্যদিকে একইভাবে বিম্বিসারের ঔরসে আম্রপালীর গর্ভজাত পুত্র বিমলকে মগধের উত্তরসূরি হিসেবে দাঁড় করিয়ে মগধের শাসনভারে হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত হয় বৈশালীর বণিকসভা। এই চরম রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেই প্রৌঢ়া আম্রপালীর পুত্রসহ প্রবজ্যা গ্রহণে শেষ হয় নাটক। থেরী আম্রপালীর হাতের কলমে বিদেহ মুক্তির সুরেই উঠে আসে সমাজবদ্ধ নারীদের মুক্তির কথা।
'থেরীগাথা আম্রপালী' নিছক একটি গল্পবৃত্ত সম্পূর্ণ করেনি, কিংবা কেবল একটি চরিত্রের কথাই সেখানে প্রাধান্য পায়নি। কখন যেন নাটকের প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে তদানীন্তন সময়কাল। এক অর্থে বলতে গেলে, বুদ্ধ ও তৎকালীন আর্যাবর্ত। সেখানকার রাজা, বণিক, শ্রমণ, দাসদাসী প্রত্যেকেই এক এক সময়ে উঠে আসে মঞ্চে। আম্রপালীর জীবনগাথা এখানে একটি প্রবাহিত নদীর মতো। দুপাশের গ্রাম ও নগরের ওপর দুরন্ত আলোকপাত করতে করতে তার এগিয়ে চলা। কখনও বা পরিবর্তন করে ফেলা গতিপথ।
একইভাবে তৎকালীন সময়কে সামনে রেখে বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের অবনমন, রাজনীতির ওপর ধর্মের স্পষ্ট প্রভাব ইত্যাদিও উঠে এসেছে নাটকে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে চেল্লানা, দেবদত্ত ও বর্ষকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। বিম্বিসারের চরিত্রে সৌম্যকে তাঁর স্বাভাবিক উচ্ছল অভিনয়ের মধ্যেই পাই। সেই তুলনায় অন্যান্য চরিত্রের পাশে আম্রপালীর চরিত্রটি কিছু দুর্বল হয়েছে। আম্রপালীর চরিত্রে আরও আলোকপাত প্রয়োজন। স্বল্প সময়ের দৃশ্যে থেরী আম্রপালীর চরিত্রটি দর্শকের মনে দাগ কেটেছে।
সঙ্গীত নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই। 'সময় বহতা স্রোত' আড়াই হাজার বছর পূর্বের স্রোত মাঝেমাঝে ছুঁয়ে গেছে বর্তমানের তীর, সেই একই রণভেরীবাদ্যে। শুধু একটি গল্প নয়, চক্রাকারে সেই একই কালাবর্তের কথা ধ্বনিত হয়ে চলেছে থেরীর গাথায়, আম্রপালীদের গাথায়।
Comments